কেস-স্টাডি ২০০৩

কস্তুরী দাশ



২০০৩ ইনস্টিটিউটের কাজে হাওড়া জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিষয় ছিল, মাতৃমৃত্যু এবং তার কারণ অনুসন্ধান আমরা  গিয়েছিলাম হাওড়া জেলার পাঁচলা গ্রামে যে পরিসংখ্যান আমরা হাতে নিয়ে গিয়েছিলাম তাতে ছিল ১৯৯৯-২০০৩ এর মধ্যে  পাঁচলা, ডোমজুর অঞ্চলে মোট ৪ জন মায়ের মৃত্যু হয়েছিল বাচ্চা হতে গিয়ে কিন্তু কাজ যত এগোলো তাতে যে তথ্য সামনে এলো তা হলো, জন নয়- সর্বমোট ১২ জন মায়ের গর্ভাবস্থায়, প্রসবকালীন বা তার পরবর্তী ৪২ দিনের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে
যে চারটি বাড়ির মাতৃমৃত্যুর তথ্য সংগ্রহ করতে যাই, সেখান থেকেই অন্য ১০ টি একই কেসের কথা সামনে আসে

পাঁচলা, ডোমজুর অঞ্চলে সে সময়ে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছনো বিরাট সমস্যার ব্যাপার ছিল গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গভীর খালে সে সময় নৌকো চলাচল করতো প্রসবের ক্ষেত্রে লোকাল দাইদের ওপরই ভরসা করতে হতো আর যদি কোনো জটিলতা তৈরী হতো তখন গ্রামের মধ্যে দিয়ে ভ্যানে করে প্রসূতি কে এনে তারপর নৌকোয় খাল পাড় হয়ে নিকটবর্তী প্রাইমারী হেলথ সেন্টারে (PHC) আনতে হতো ওই দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে করতে যে সময় অতিবাহিত হতো, তাতে অতিরিক্ত রক্তপাতের কারণে একজন মা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো তাই দুরত্ব অন্যতম কারণ ছিল মাতৃমৃত্যুর, বিশেষত যারা ওই প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বাস করতেন এছাড়া, দাইদের অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ, রক্তাল্পতা, খিঁচুনি, উচ্চ রক্তচাপ, অতিরিক্ত রক্তপাত, টিটেনাস এসব কারণ তো ছিলই
আমরা যে চারটে মাতৃমৃত্যুর কেস নিয়ে পাঁচলাডোমজুর অঞ্চলে গিয়েছিলাম, তার মধ্যে একটিমাত্র কেস ছিল পাঁচলায় অন্যগুলো ডোমজুরে
বাস রাস্তা পেরিয়ে একটা চওড়া খাল, তার জল কুচকুচে কালো তার ওপর দিয়ে একটা বাঁশের নড়বড়ে সাঁকোর ওপর দিয়ে খাল পেরিয়ে আমরা সেই বাড়িতে পৌঁছেছিলাম খালের একদম ধারেই সেই বাড়ি একতলা, মাটির বাড়ি, মাথায় টালি দুটো ঘরের সমান্তরালে টানা দাওয়া, সুন্দর ছিমছাম

যে দিন আমরা সেখানে গিয়েছিলাম, তার থেকে মাত্র দিন পনেরো আগেই ঘটেছিল সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা সেইসময় বাড়িতে ছিলেন সদ্য মৃত বউটির শাশুড়ি মা উনিই কথা বলছিলেন সেই বাড়িতে আমাদের পৌঁছনোর খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়া মাত্র একটু একটু করে অনেক লোক জড়ো হয়ে গেল ওই বাড়ির উঠোনে, কাজ ফেলে ছুটে এসেছিল বউটির স্বামীও খুবই রাগত ভঙ্গিতে সে আমাদের দিকে তাকিয়ে আবার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়েও গিয়েছিল সেখান থেকে বুঝতে পারছিলাম এদের কি অসময়ে এসে আমরা খাতা কলম খুলে বসেছি খারাপ লাগায় মন ভরে উঠলেও, কেস তা তো নিতেই হবে ভেবে শুনতে শুরু করেছিলাম সেই ঘটনা প্রবাহ। 
বউটির শাশুড়ি মা আমাদের ওই দাওয়ায় আসন পেতে বসতে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন বলেছিলেন..'ওদের সবে একবছর বিয়ে হয়েছিল বউয়ের আট মাসের পোয়াতি ছিল কিছুদিনের মধ্যেই সন্তান আসবে সেই সু-খবরে সুন্দর কাটছিল আমাদের সময় হসপিটালে কার্ডও করা হয়েছিল নিয়মমতো চেকআপ, আয়রণ বড়ি, ওষুধপত্র সবই ঠিক ঠাক করাচ্ছিল আমার ছেলে বউকে খুব যত্নেই রাখতাম আমরা ছেলের প্রথম সন্তান, তাই অনেক আনন্দ ছিল

সেদিন রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর, ওরা দুজন ওদের ঘরে শুতে চলে গেল আমিও আমার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম আমরা সবসময় মশারি টাঙিয়ে, পাশে টর্চ নিয়ে শুই সেদিনও তাই শুয়েছিল ওরা মাঝরাতে, বউ হঠাৎ চিৎকার করে বলে ওকে কি কামড়েছে মনে হচ্ছে ছেলে সঙ্গে সঙ্গে টর্চ জ্বালিয়ে দেখে বিরাট একটা সাপ ফনা তুলে তখনও বিছানায় রয়েছে ছেলে সাপ টিকে মারতে উদ্যত হলে বউ মারতে দেয়না বলে সাপ টিকে মারলে ওর সন্তানের ক্ষতি হয়ে যাবে ওকে যেতে দিতে বলে
এরমধ্যেই আমি ওদের ঘরে কি হয়েছে বুঝতে না পেরে দরজায় ধাক্কা দিই ঘর খুলতেই দেখি বউ নিজেই কাপড়ের বাঁধন দিচ্ছে পায়ে বলে সাপে কামড়েছে সাপটি তখনও বিছানাতেই ছিল বউ কিছুতেই সাপটাকে মারতে দিলোনা খালি  বলছিল ওকে চলে যেতে দাও মেরোনা তারমধ্যেই দেখতে পেলাম, সাপটিকে খাল ধারের জানলা দিয়ে বেরিয়ে যেতে
তখন রাত তিনটে হবে ছেলে গেল ভ্যানের খোঁজে ওই শীতের রাতে ভ্যান খুঁজে আনতে আনতে ঘণ্টা পেরিয়ে গেল তখনও বউ ঠিক ছিল ওরা ওকে ভ্যানে করে পাঁচলায় নিকটবর্তী গ্রামীণ হসপিটালে নিয়ে গেল ওরা ভর্তি নিলোনা বলেছিল সাপটাকে না আনলে ওরা কিছু করতে পারবে না কলকাতায় বড় হসপিটালে নিয়ে যেতে বলেছিল ততক্ষণে বউ ঝিমিয়ে পড়তে শুরু করেছে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছিল, একটা গাড়ি জোগাড় করে ওরা কলকাতার পথে রওনা হয়েছিল ওদের চোখের সামনেই বউটা নেতিয়ে পড়েছিল একদম কলকাতায় হসপিটালে যখন পৌঁছেছিল, ওরা ভর্তি নেয়নি বলেছিল, অনেক্ষণ আগেই সব শেষ হয়ে গেছে'...

সেদিনের কেস স্টাডি খাতায় লেখার দরকার পড়েনি কারণ ওই কেসটা সংজ্ঞা অনুযায়ী মাতৃমৃত্যু ছিলোনা একটা একসিডেন্ট হাড় হিম করা একটা ঘটনা মনটা মুচড়ে উঠেছিল কি বলবো, কিভাবে বলবো, সান্ত্বনার কোনো ভাষা ছিলোনা হৃদয়বিদারক এই ঘটনা শুনে যখন উঠতে যাব, তখন ওই মাসিমা বললেন, 'বাকিটা শুনে যাবেনা'..
উনি বলেন, 'বউটা চলে যাবার ঠিক একসপ্তাহ পরে, এই যে তুমি এখানে বসে আছো, ঠিক এইখানে বসে আমি আটা মাখছিলাম বউই মাখতো রোজ এখন আমাকেই করতে হচ্ছেযতই শোকের অবস্থা থাক, খাওয়া দাওয়া সংসারের কাজ যথা নিয়মেই চালাতে হচ্ছিল হঠাৎ মনে হলো, কি যেন একটা বড়সড় পায়ের পাশ দিয়ে চলে গেল সেটা আমার ঘরের দিকেই গেল তাড়াতাড়ি লম্ফটা নিয়ে ঘরে গিয়ে দেখি, বিরাট একটা কালো সাপ আমার চালের ড্রাম ঘিরে রয়েছে প্রথমেই মনে হলো, দিই শেষ করে তারপর মনে হলো, সেও তো মারতে দেয়নি আজ কি সেই এলো !!..
লম্ফর আলোয় দেখলাম, সাপটা আমার ঘর থেকে বেরিয়ে ওদের ঘরের দিকে চলে গেল আলো নিয়ে যেতে যেতে জানলায় সাপের ল্যাজটুকু দেখতে পেয়েছিলাম '...

ফিল্ডে ঘুরতে ঘুরতে কত ঘটনাই সামনে আসে মনে ছাপ রেখে যাওয়া কিছু ঘটনার মধ্যে এটা অন্যতম বার বার ওই ছেলেটির (বউটির স্বামী) চোখের সেই রাগ অভিমান মেশানো জ্বলন্ত দৃষ্টি মনে পড়ে যায় মনে পড়ে এক শ্বাশুড়ি মায়ের বিশ্বাসের কথা যে বিশ্বাসে ওই বিষাক্ত সাপ কে দ্বিতীয়বার নিষ্কৃতি দিয়েছিলেন
হ্যাঁ, ওই কেসটা, মাতৃমৃত্যুর কেস ছিলোনা আমাদের অফিসিয়াল কাজে লাগলো না কিন্তু, যে স্বপ্নের লালন ছিল ওই বউটির মনে, তার শ্বাশুড়ি মায়ের মনে, তার স্বামীর মনে - তার এমন অকাল সমাপ্তিতে আজও মন খারাপ হয়ে যায় অভিজ্ঞতার ভারবাহি এই ঘটনা চিরকাল মনে থাকবে অল্পবয়সী সেই বধূটির প্রতি শ্রদ্ধা, চিরশান্তি জানাই করুণাময়ের কাছে

*ছাত্রী, ১৯৯৪


মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পায়ে পায়ে প্রাসাদ নগরী...

এঞ্জেলবার্গের তিনটি দিন

সময়